Wednesday, July 31, 2013

ভালোবাসা – ০২


[পড়া শুরু করার আগে দয়াকরে ফুটনোটটা পড়ে নিন।]
যখন খুব ছোট ছিলাম তখন নাকি প্রায়ই জর আসলে চোখ উল্টে যেত। অচেতন হয়ে যেতাম। বাড়ি শুদ্ধ লোকের হুড়মুড় লেগে যেত! রাত যত গভীরই হোক গ্রামের অনেকেই খবর শোনা মাত্র আমাকে দেখতে চলে আসতো। ‘গ্রামের অনেকেই’ বলাটা মনে হয় ঠিক হচ্ছেনা! আমি আসলেই একটা অকৃতজ্ঞ! তাঁরা আমার বাড়ির বা রক্তের সম্পর্কের কেউ না হলেও আমার জন্য যতটুকু ভালোবাসা দেখিয়েছেন আমি সবটুকু বলে শেষ করতে পারব না। তাঁদের অনেক গল্প আম্মুর মুখে শোনা আবার অনেক গল্প শুনেছি ছোটমনির কাছে।

এক 
আমার জন্মের ঠিক দুই দিন আগে পাশের বাড়ির এক চাচীর ছেলে জন্মের সময় মারা যায়।

তিনি সম্ভবত আমার মধ্যে তাঁর সেই মারা যাওয়া সন্তানকে খুঁজতেন। আমাকে দিনের মধ্যে অন্তত একবার তাঁর বাড়িতে নিয়ে না গেলে শান্তি হতো না! মায়ের দুধ ছাড়ার পর তিনি নাকি আমাকে একবেলা খাওয়াতেন। সকাল-বিকেল আমি কখন খাচ্ছি, কখন ঘুমাচ্ছি, কখন পটি করছি সব খবর তাঁর কাছে থাকতো! এমন কি আমি কোন পাড়ার, কোন বাড়িতে, কখন থাকি এই খবরও আম্মু ঐ চাচীর কাছে নিতেন! বুদ্ধি হওয়ার পরেও দেখেছি উনি আমাকে কত ভালোবাসতেন। আর আমি কত বড় অকৃতজ্ঞ তাঁর নামটাও ভুলে বসে আছি! “চাচী, আমাকে মাফ করে দেবেন। আপনার সামনে দাঁড়িয়ে যে ক্ষমা চাইবো সে উপায়টাও আপনি রাখেননি। কার উপর জানি অভিমান করে চলে গেলেন না ফেরার দেশে!” 

দুই
আমাদের বাড়ি থেকে একটু দূরে একটা বাড়িতে মুরগীর মাংস রান্না হবে আর ঐ বাড়ি থেকে একজন আমার জন্য মুরগীর কলিজা-মাথা-মাংস পাঠাবেন না এটা নাকি প্রায় অসম্ভবের কাছাকাছি ছিল! এবার আরেক মায়ের গল্প। উনাকে আমি বড়মা ডাকি (আমি আরও ২ জনকে বড়মা ডাকি, তাঁদের গল্পও পরে কোনো একদিন হবে)/ তো আমার আম্মুর সন্দেহ আমার জন্মের পর থেকে আমি অনেক খানি বড় হওয়ার আগ পর্যন্ত বড়মায়ের নিজের ছেলে-মেয়ে মুরগীর কলিজা খেতে পায়নি! কারণ সব কলিজাতে ভাগ বসাতাম আমি! তাছাড়া তিনি গাছের কলা, পেয়ারা প্রথমে আমার জন্য পাঠিয়ে দিয়ে পরে অন্যদের দিতেন! কারণ আমি নাকি তাঁর জন্য লাকি! কত ভালোবাসা বড়মা আমার জন্য দেখিয়েছেন। তার এক আনাও কি আমি ফেরত দিতে পেরেছি? না, পারি নি! কারণ আমি অকৃতজ্ঞ! গত জানুয়ারি মাসে বাড়ি গিয়ে অনেক দিন পর বড়মার সাথে দেখা। উনি শুধু একটা কথাই বললেন, “আমার ছেলে বড় হয়ে গেছে!” 
“বড়মা! সে দিন খুব খারাপ লেগেছিল...আপনার চোখের দিকে তাকাতে পারিনি। ঐ যে কারণটা আপনিই তো বলেছিলেন ‘ছেলে বড় হয়ে গেছে’! মায়ের কাছে ছেলের মাফ চাইতে হয়না। মায়েরা সব বুঝতে পারেন! আমি জানি আপনি আপনার ‘বড় হয়ে যাওয়া ছেলের’ মন পড়ে মাফও করে দিয়েছেন।”

তিন
আরেক জন ছিলেন বুড়িমা। থুরথুরি এক বুড়ি। বুড়ির বাড়ি আরেক গ্রামে। কবে জানি আমার ঐ বুড়িমা শুনেছিল আমি শাক খেতে ভালোবাসি। তারপর থেকে সপ্তাহে প্রায় এক বা দুই দিন বুড়িমা আমার জন্য অনেক দুরের পথ হেঁটেহেঁটে শাক নিয়ে হাজির হতেন! আম্মু অনেক নিষেধ করত, কিন্তু তিনি শুনতেন না! আমার মনে পড়ে উনি বিছানাতে পড়ে যাওয়ার পরও আমার জন্য মানুষের হাত দিয়ে শাক পাঠাতেন! আমি উনাকে দেখতে গিয়ে অনেক বার উনার বাগান থেকে নিজ হাতে শাক তুলে এনেছি! কয়েক বছর আগে আম্মু আমাকে ফোন করে জানাল আমার সেই বুড়িমা মারা গেছেন! আমি তাঁর জানাজা করতে পারিনি, তখন ঢাকাতে ছিলাম। 


এমন আরও অনেকেই আছেন। তবে বিকেলে জরের ঘোরে এই তিনজনের কথা খুব মনে পড়ছিল। দুইজন আমাকে ছেড়ে কবেই চলে গেছেন। বাঁকি বড় মা’রও বয়স হচ্ছে। এই আধমকে তাঁরা যে মমতা দিয়েছেন তা এই জীবনে ফিরিয়ে দিতে পারবনা। ভালোবাসা-মায়া-মমতা এমন জিনিস যা কখনো ফিরিয়ে দেওয়া যায় না। 

[[বেশ কিছু আগে ভালোবাসা-০১ (নাম সমাচার) নামে একটা লেখা দিয়েছিলাম। তারই ধারাবাহিকতাতে ভালোবাসা-০২ লেখলাম। বুঝতে পারছি এই সব লেখা অর্থহীন। কিন্তু মাঝে মাঝে অর্থহীন লেখা দিতে ভাল লাগে। শুধুমাত্র নিজের মানুষিক শান্তির জন্য। যদি ফুটনোটটা আগে পড়ে থাকেন তবে বলি হাতে যথেষ্ট ফ্রি সময় থাকলেই কেবল লেখাটা পড়ুন। একজনের জীবনের প্রলাপ পড়ে অযথা সময় নষ্ট করার মানে নেই!]]

শূন্য পথিকের মূল পোষ্ট>>

No comments:

ফেসবুক প্লাগইন: শূন্য পথিক by শূন্য পথিক (ফেসবুকে আমি) →ফেসবুকে অ্যাডমিন- হুমায়ূন আহমেদ ফ্যান পেজ

Post a Comment