Monday, July 8, 2013

অনুগল্পঃ মায়াময় ভালোবাসা


রাত ৩টা বেজে ৪৫ মিনিট। ঘড়ি তার আপন মনে সময় জানান দিয়ে যাচ্ছে। অবনীর আরও একটি নির্ঘুম রাত। শিহাবকে আজও খুঁজে পাওয়া যায়নি। গত তিন দিন ধরে শিহাব নিখোঁজ। শিহাবের বন্ধু, পরিচিত কয়েকজন, থানা সব জায়গাতে অবনী তার মুঠোফোন নাম্বার দিয়ে রেখেছে। দিনে অথবা রাতে যখনই জীবিত অথবা মৃত শিহাবের খবর পাওয়া মাত্র যেন তাকে জানানো হয়। লাশ পাওয়া যাওয়ার সম্ভবনাটাই নাকি বেশি। উত্তরা থানার ওসি জামিলুর রহমান অবনীর ভাইয়া আবীর চৌধুরীর বন্ধু। তিনি বললেন শিহাব নাকি রাজনীতির সাথে জড়িত ছিল। তার সন্দেহ, ভিক্টিম রাজনৈতিক গুম। তাই তিনদিন পরে জীবিত পাওয়ার সম্ভবনা খুবই ক্ষীণ। লাশটাও পাওয়ার সম্ভবনাও খুব কম। পাওয়া গেলেও বিচ্ছিন্ন ভাবে।
ঢাকার ভেতরে ও আশা পাশের সব থানাতে খবর পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। জামিল ভাই এখনো হাল ছাড়েন নি।

শিহাব যে রাজনীতি করত এটা অবনী জানতো না। ওর জানার কথাও না। আসলে শিহাবকে অবনী ভাল মত চেনেই না! অবনীদের বাসার পাশে একটা টং চায়ের দোকানে কিছু হ্যাংলা ছেলে নিয়মিত আড্ডা দিত। যাওয়া আসাতে প্রায়ই ওদের দেখত। ঐ চায়ের দোকানে শিহাবের সাথে অবনীর পরিচয়। পরিচয় বললে ভুল হবে। লাজুক চুপচাপ ধরনের একটা ছেলে। খুব কম কথা বলত। নিজের সম্পর্কে তো আরও কম। 
একদিন বিকেলে ভার্সিটি থেকে ফিরে রিকশা ভাড়া দিতে গিয়ে অবনী দেখল ব্যাগে ভাংতি টাকা নেই। আশে পাশে খোঁজ করে রিকশাওয়ালাও ভাংতি করতে পারল না। তখন একটা ছেলে এসে ভাড়ার টাকাটা দিয়ে দিল। অবনী অনেক না করার পর ছেলেটা বলল,
বাসায় গিয়ে কাউকে দিয়ে টাকাটা ঐ দোকানে পাঠিয়ে দেবেন। আমি শিহাব। আমি ওখানে থাকব।
অবনী কিছু বলার আগেই ছেলেটা হাঁটা শুরু করল। হতভম্ব অবনী বাসায় গিয়ে কাজের ছেলের হাতে টাকাটা পাঠিয়ে দিল। বেশ কিছুক্ষণ পর সে ফিরে এসে জানাল ওখানে শিহাব নামে কেউ নেই, চলে গেছে। অবনী মনে মনে বিরক্ত হল। রিকশা ভাড়া দিয়ে রোমিওগিরি!


এই ঘটনার পর থেকে শিহাবের আর কোনো দেখা নেই। যাওয়া আসার পথে মাঝে মধ্যেই সে দোকানে খোঁজ নিত। না, সে অনেক দিন হয় আর আসে না। প্রায় দু’সপ্তাহ পর শিহাবের সাথে তার দেখা অবনীর ভার্সিটির সামনে। সে দাঁড়িয়ে একজনের সাথে কথা বলছিল। একরাশ বিরক্ত ভাব নিয়ে অবনী এগিয়ে গেল,
-আপনি শিহাব না?
-ও! কেমন আছেন?
-আপনি তো আজব মানুষ! সে দিন টাকা না নিয়ে কোথায় উধাও হয়ে গেছেন? 
-একটু ঝামেলাতে ছিলাম সরি।
-সরি আপনি না, সরি আমি! আপনার কাছে থেকে টাকাটা নেওয়াই আমার ভুল হয়ে গেছে! আপনাকে খুঁজতে খুঁজতে মাথা নষ্ট! আমাকে উদ্ধার করুন! এই নিন আপনার টাকা...
-থামুন থামুন! এই কয়টা টাকার জন্য আপনাকে অস্থির হতে হবে না! আর আমি এখানে টাকা তুলতে আসি নি!
-তো কেন এসেছেন? দাতা সাজতে? তো আবার কার উপকার করলেন শুনি?
-আপনি আমার উপর ভালই ক্ষেপে আছেন দেখছি! আপনাদের ভার্সিটির আমার এক ছোট ভাইয়ের একটা সমস্যা ছিল...
-আর আপনি সমাধান করে দিলেন?
-আপাতত সমাধান হয়েছে বলেই মনে হচ্ছে!
-বাহ্‌ আপনি তো বিশাল সমাজ সেবক!
-হাঃহাঃ! তা আর হতে পারলাম কই! 
-আপনি সবার সমস্যার সমাধান করেন নাকি শুধু ছোট ভাইদের...?
-আপনারটাও করতে পারি! আছে নাকি কোনো সমস্যা? বলতে পারেন!
-জী না! আপনি আপনার টাকাটা ধরেন! আমি আসি!

টাকা দিয়ে অবনী বাসায় রওনা দিল। সে মিথ্যা বলেছে তার কোনো সমস্যা নাই! ইদানিং সে একটা সমস্যার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। সমস্যাটা তার ডিপার্টমেন্টের এক শিক্ষককে নিয়ে। বেশ কিছুদিন ধরে রুদ্র স্যার অবনীকে বিব্রত করে চলেছে। দিন রাত ফোন দিতেই থাকেন, মাঝে মাঝে তার রুমে ডেকে পাঠান। তার মতি গতি ভাল না। কমপ্লেন করেও কোনো লাভ নেই। অতীতে অন্যদের এই ধরনের সমস্যার কোনো সমাধান আসেনি। শিহাবকে বলে দেখবে? নাহ্‌ অপরিচিত মানুষদের এই সব পার্সোনাল ব্যাপারে জড়ানো ঠিক না। 

দিন যত যেতে লাগলো রুদ্র স্যার তত ঝামেলা শুরু করা শুরু করল। ব্যাপারটা বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে যেতে শুরু করল। অবনী বাধ্য হয়ে ভার্সিটি অথরিটি আর ভাইয়াকে জানাল। এতে তেমন কাজ হল বলে মনে হয় না। একদিন ভার্সিটি যাওয়ার পথে অবনী দেখল শিহাব দোকানে আড্ডা দিচ্ছে। 
-শিহাব একটু শুনবেন?
-ও আপনি, হুম বলেন...
-এই দিকে আসুন।
অবনী শিহাবকে সব কিছু খুলে বলল। ‘আপনার নাকি অনেক জানা শোনা... প্লিজ আমাকে একটু হেল্প করুন!’
-আপনি কোনো চিন্তা করবেন না, ২-৩দিন অপেক্ষা করুন। নামটা কি বললেন? রুদ্র আনোয়ার?
-হুম। কিন্তু দেখবেন কোনো ঝামেলা যেন না হয়। বোঝেনই তো...
-আপনি চিন্তা করবেন না। উনি ঠাণ্ডা হয়ে যাবেন। আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন। আপনার নাম সামনে আসবে না।
এর দুই দিন পরের ঘটনা, আশ্চর্য জনক ভাবে রুদ্র স্যারের ফোন আসা বন্ধ হয়ে যায়। মাঝে উনি এক দিন ভার্সিটিতেও আসেননা। পরের দিন শোনা গেল উনি চাকরী ছেড়ে দিয়েছেন!


শিহাবকে একটা ধন্যবাদ দিতে হবে! কিন্তু সে আবার হাওয়া! আড্ডার কেউ কিছু বলতে পারে না। একজন শুধু বলল কিছু একটা ঝামেলা হয়েছে।
এই ঘটনার বেশ কিছুদিন পর গত তিন দিন আগে শিহাব অবনীর সাথে দেখা করতে এসেছিল। কিন্তু অবনীর সাথে তার দেখা করা হয়নি। সেই রাতে শিহাবের এক বন্ধু অবনীকে ফোন করে জানায় আড্ডা থেকে ফেরার পথে একটা প্রাইভেট কারে কিছু লোক ওকে জোর করে তুলে নিয়ে যায়। তারপর থেকে সে নিখোঁজ। 
সামান্য পরিচয়ে একটা মানুষের জন্য মায়া দেখে অবনী নিজেই অবাক হয়। বনের পাখি উড়ে গেলেও নীড়ে পালক রেখে যায়, পালক গুলো মায়া। কে জানে এই মায়াটাই হয়ত ভালোবাসা! 

শূন্য পথিকের মূল পোস্ট>>

No comments:

ফেসবুক প্লাগইন: শূন্য পথিক by শূন্য পথিক (ফেসবুকে আমি) →ফেসবুকে অ্যাডমিন- হুমায়ূন আহমেদ ফ্যান পেজ

Post a Comment